আজ ২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৮ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

কাজী নজরুল ইসলাম এর জন্ম তারিখ নিয়ে কিছু কথা?

– মুহাম্মদ শামসুল হক বাবু

( এই লেখাটির মাধ্যমে প্রচলিত ভুল ধারণার সমাপ্তি ঘটুক। বিভিন্ন মাধ্যম হতে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে এবং পড়ে আর অবশেষে গবেষণা করে দেখলাম বিশ্ব আধ্যাত্মিক কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর জন্ম তারিখ নিয়ে বিভ্রান্তির জবাব ও মূল্যবান কিছু অজানা কথাই এখন আপনাদেরকে সারসংক্ষেপে বলছি! আসুন তাহলে একটু সময় নিয়ে জেনে বুঝে চলি। )

 

আজ থেকে প্রায় ৩ বছর আগের কথা। ভারতে অবস্থিত কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় এর তরফ থেকে ২০১৮ ইং সালের একটি ছুটির তালিকা প্রকাশিত হয়েছিল। ঐ সেই ছুটির তালিকা (প্রতিষ্ঠানিক বাৎসরিক ক্যালেন্ডার) ঘিরেই সর্বপ্রথম বিতর্ক শুরু হয়েছিল ভারতের আলোচিত আসানসোল রাজ্যের শিল্পাঞ্চল এলাকা জুড়ে। ঐ তালিকায় দেখা গিয়েছে, সাধক কবি নজরুলের জন্মজয়ন্তী ভুল ছাপা হয়ে গেছে। এখন উপায়? নিরুত্তর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক শিক্ষক সহ প্রশাসনিক কর্মকতাগণ।

 

বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেশ জাতি ও বিশ্বকে পথভ্রষ্ট করা যাবে না। গুণীর কদর বোঝেনি যে জন সে জন মানুষ নহে অমানুষ! যদি তার হাতে থাকে কলম তাহলে বুঝবে ওটা কলম নয় ওটা বিষাক্ত খঞ্জন!

 

উল্লেখ্য প্রায় এক মাসের বেশি সময় ধরে এই ভুল তথ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ওয়েবসাইটে বিদ্যমান থাকায় ব্যাপার সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এবং সমালোচিত হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় এর সংশ্লিষ্ট তৎকালীন কর্তৃপক্ষ মহোদয়।

 

এ নিয়ে এরপর একের পর এক কথা হলো, একের পর এক আলোচনা হলো, সর্বশেষ সিদ্ধান্তেঃ যদিও কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন রেজিস্ট্রার মিস্টার অমিত আব্রাহাম জানিয়েছিলেন যে, অতিদ্রুত এবং অবিলম্বে এই সংক্রান্ত ভুলটি শুধরে নেওয়া হবে বলে এই আশ্বাস দিয়েছিলেন কিন্তু প্রযুক্তির উৎকর্ষতা থাকলেও সেই কাজটি সাথে সাথে করা হয়নি বরং বলা চলে আলাপ আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি।

 

বিশ্ব বরেণ্য কবির জন্ম ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- দুখ মিয়া ওরফে কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন ছিল মূলতঃ ২৪ শে মে কিন্তু আগেই বলেছিলাম নজরুলের নামাঙ্কিত আসানসোল এ অবস্থিত কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব প্রচার ও প্রকাশনা বা পাবলিকেশন সেল এর ওয়েবসাইট হতে প্রকাশিত ২০১৮ ইং সালের ছুটির তালিকায় দেখা গেছে মোটা হরফে ইনডিকেট করা নজরুল জন্মজয়ন্তী লেখা হয়েছে ২৫ শে জুন। তৎকালীন ঐ দিনটিতে অলরেডি ছুটিও ঘোষণা করা হয়েছে।

 

তাহলে এতদিনের লালিত পালিত সত্য ইতিহাসের কি হবে? প্রশ্ন থেকে যায়। কেন ই বা এহেন অপরিপক্ক পরিকল্পনাহীন অদূরদর্শী কার্যকলাপ? আসলে এরা কি চায় বা কি করতে চেয়েছিল? এদিকে জল গড়িয়েছে অনেক দূর।

 

বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এ ধরনের ভুল ধরা পড়ায় চরম পরিবেশের সৃষ্টি হয়। স্তম্ভিত ও শিউরে উঠেছিলেন শিল্পাঞ্চলের শিক্ষক-শিক্ষিকা থেকে শুরু করে পড়ুয়া ছাত্র সমাজ সকলেই। হতবাক হয়েছেন নাগরিক সমাজ সহ অনেকেই।

 

যাকে নিয়ে গবেষণা হয় যার নামে প্রতিষ্ঠিত সশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর সেখানে গোড়াতেই গলদ। ভাবা যায়! কল্পনা করা যায়!

 

ওই শহরের শিক্ষকদের বৃহৎ একাংশের অভিযোগ, তাঁরা বিষয়টি দেখার পরেই যথাসময়ে যথাসম্ভব উপায়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নজরে উক্ত বিষয়টি তুলে ধরে ছিলেন। বার বার সেই ভুল শুধরে বা সংশোধন করে নেওয়ার আবেদন করেছেন তাঁরা ব্যক্তিগত ভাবেও কিন্তু এরপরেও বুধবার বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত সেই পূর্বপ্রকাশিত তালিকা সংশোধন করে সঠিক তালিকা ঝোলানো হয়নি বা প্রকাশ করা হয়নি। এই অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের গাফিলতিকেই দ্বায়ী করেছিলেন শহরবাসী, নজরুল গবেষক ও ভক্তরা।

 

আধুনিক যুগে অবাধ তথ্যের সত্যতায় এটা একটা অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ। বিজ্ঞতা যেন অজ্ঞতায় ঘিরে ফেলেছে। এর কারণ মানসিকতা। চরম অবহেলা। নোংরা মনের বহিঃপ্রকাশ মাত্র অথবা অন্যকোনো ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্য হতে পারে।

 

পরবর্তীতে ঐ সেই দূর্ঘটনায় মর্মাহত হয়েছিলেন কবি নজরুলের পরিবারের সদস্যরা ও আত্মীয়স্বজনরাও। কাজী নজরুল ইসলামের নাতনি সোনালি কাজী বলেছিলেন, ‘‘তাঁর নানার নামাঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে এ রকম একটি অগ্রহণযোগ্য মারাত্মক ইতিহাস বিকৃতি ভুল দিনের পর দিন রয়ে গেল, তা কোনও ভাবেই মেনে নিতে পারছি না। অতএব নজরুল পরিবারের পক্ষ থেকে অবিলম্বে এই জাতীয় ভুল সংশোধন করে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।’’

 

কিন্তু তাতেও কি লাজ হয়েছে। তাতেও কি কাজ হয়েছে? না সম্ভবতঃ হয়নি। তাহলে কি করা যায়? আবারও প্রশ্নের পর প্রশ্ন উঠে এসে।

 

একটি কথা মনে রাখতে হবে- ভুল হতেই পারে কিন্তু ভুল স্বীকার করে সংশোধন করা উত্তম কাজ মহৎ কাজ, আর না করাটা বেয়াদবি আর চরম অবহেলা ও অবমাননাকর বটে যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নৈতিকতা জড়িত। তবে সে যাই হোক- তা নজরে আসা মাত্রই শুধরে নেওয়া উচিত ছিল বলে মন্তব্য করেছিলেন সেই সময়ের তৃণমূল ছাত্র পরিষদের জেলা সভাপতি কৌশিক মণ্ডল।

 

এসএফআইর জেলা সহ-সম্পাদক হিমগ্ন চন্দ বলেন, ‘‘আমরা ভাবতে পারছি না কী ভাবে এই ভুল এতদিন ধরে রেখে দেওয়া হল? বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অবিলম্বে নিজেদের ভুল স্বীকার করে বিবৃতি দেওয়া উচিত।’’

 

আমাদের মনে রাখতে হবে- ভুল স্বীকার করলে কেউ ছোট হয়ে যায় না। আরও বড় হয়। ব্যক্তি ও পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ ও রাষ্ট্রে তাহার গ্রহনযোগ্যতা বাড়ে। শিক্ষকরা ভুল করলে সেটা মেনে নেয়া কষ্টকর।

 

পরবর্তীতে বিষয়টি নিয়ে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীর নজরেও এনেছেন বলে জানিয়েছিলেন আসানসোলের কলেজ শিক্ষক শ্রী চন্দ্রশেখর কুণ্ডু মহাশয়। তিনি বলেন, ‘‘বোঝাই যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজকর্মে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। কারণ, কেউ একজন ভুল করতে পারেন। সবারই একসঙ্গে কাজ করলে ভুল হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারকেরা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে একসঙ্গে মিলেমিশে কাজ করলে এই ভুল হতো না।’’ কথাটি খাঁটি কথা সত্য কথা ও দামী কথা আর শিক্ষনীয়ও বটে।

আমাদের দেশে অনেকেই নিজেদের বড় বড় কবি সাহিত্যিক লেখক দাবী করে, এমনকি তারা নজরুল গবেষকও দাবী করে থাকে, আসলেই কি তারা প্রকৃত অর্থে নজরুল গবেষক? আমি সন্ধিহান। আমাদের দেশে তেলবাজের অভাব নেই। এরাই সাহিত্যকে কুলষিত করছে। ধ্বংস করে দিচ্ছে। ইতিহাস ঐতিহ্য বিকৃতি একটি জঘন্য অপরাধ। সাহিত্যের জগতে এটা দূষনীয় ও সত্যের পরিপন্থী কাজ। ইতিহাসকে রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত করে কি লাভ? মনে রাখবে ইতিহাস তার আপন গতিতেই চলেছে, চলে ও চলবে চিরকাল।

 

অতএব আমি ব্যক্তিগত ভাবে আশা করি যে, ২৫ তারিখ নয় ২৪ তারিখই এবং জুন মাস নয়- মে মাস বিশ্ব আধ্যাত্মিক কবি- সাম্যের কবি- মানবতার কবি- বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর জন্মদিন এবং সেভাবেই সবাই শ্রদ্ধা ও আলাপ আলোচনা সহ অনুষ্ঠান পালন করা হবে এটাই সকলের প্রত্যাশা।

 

বিদ্রঃ- কবি ও কলামিস্ট (গবেষক ও প্রাবন্ধিক)

     এ বিভাগের আরো সংবাদ
Share via
Copy link
Powered by Social Snap