আজ ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

প্রাণীসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগীতায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে বেবী আক্তারের জীবন

বিশেষ প্রতিনিধি, সাভার ( ঢাকা)

ঢাকার সাভারে অবস্থিত মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ প্রাণী সম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট ( বিএলআরআই) এর দেয়া দেশীয় জাতের দশটি মুরগি পালন করে, জীবনের মোড় ঘুরে দাঁড়িয়েছে, ধামরাই উপজেলার শরিফবাগ ইউনিয়নের বেবি আক্তারের।

২০১৯ সালে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণায় সৃষ্টি ‘মাল্টি কালার টেবিল চিকেন’ উন্নত জাতের দেশীয় মুরগি পালন শুরু করে বেবি আক্তার। দেশে মহামারী করনা দেখা দিলে, এই দশটি মুরগি দিয়েই ভাগ্যের চাকা ঘুরতে থাকে তার।

বেবি আক্তার বলেন ২০১৯ সালে পার্শ্ববর্তী একটি খামার পরিদর্শনে আসেন বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট এর রাজিয়া আপা। এ সময় আমি আপার কাছে আবদার করে বলি, আপনারা অনেককেই অনেক কিছু দিচ্ছেন আমাকেও কিছু দিন।

তার আবদার শুনে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ফার্নিং সিস্টেম রিসার্চ ডিভিশনের বিভাগীয় প্রধান ডঃ রাজিয়া খাতুন তার বাড়ি পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি বেবি আক্তারের বাড়ির পরিস্থিতি দেখে, সিলেক্টিভ ব্রিডিং এর মাধ্যমে ইমপ্রুভমেন্ট করা, দেশীয় উন্নত জাতের ১০ টি মুরগি ও কিছু মুরগির খাবার প্রদান করেন তাকে। যত্ন সহকারে আটটি মুরগি ও দুটি মোরগ লালন পালন করতে থাকেন বেবি আক্তার। এই মুরগির ডিম বিক্রি করে সঞ্চয় করেন কিছু টাকা। ২০২০ সালে জানুয়ারি মাসের ৭ তারিখ ডিম বিক্রি করে জমানো ২৩০০ টাকা দিয়ে, নিজ বাড়ির আঙিনায় শুরু করেন একটি চিপসের দোকান।

দোকান করার চিন্তা ও ইচ্ছে কেন হলো ? এমন প্রশ্নের জবাবে বেবি আক্তার বলেন, বাড়ির পাশেই নতুন একটি বড় মহিলা মাদ্রাসা চালু হয়েছে। মাদ্রাসার ছাত্রীদের কেনাকাটার জন্য অনেক দূরে যেতে হয়, কোন কোন সময় ছোট মেয়েরা কান্না করত চিপস খাওয়ার জন্য, যা দেখে একদিন আমার মাথায় চিপসের দোকান দেয়ার বুদ্ধি আসে। তখন আমার ডিম বিক্রি করে জমানো তেইশ শত টাকা দিয়ে, কিছু চিপস এনে বাড়ির বারান্দায় ঝুলিয়ে দেই। এভাবে কিছুদিন যেতে না যেতে ২০২০ সালের করোনা মহামারীতে চলে যায় আমার স্বামীর চাকুরী। চাকুরী হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পরি স্বামী ও ২ সন্তান নিয়ে। বন্ধ হয়ে যায় ইনকামের সব রাস্তা।

তবে বন্ধ হয়নি বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে দেয়া সেই ১০টি মুরগির ডিম পাড়া। মুরগিগুলো বিশেষ উন্নত জাতের হওয়ায় প্রতিদিন নিয়মিত ডিম পেরেই যেত। সেই ডিম বিক্রি করে সাংসারিক খরচের পাশাপাশি অল্প অল্প করে সঞ্চয় করে দোকানের ব্যবসা বৃদ্ধি করতে থাকি। এভাবেই জানাচ্ছিলেন বেবি আক্তার, তার সংগ্রাম করা জীবনের ভাগ্যের চাকা ঘুরতে থাকার গল্পে ।

এখন তার বাড়িতে ছোট্ট একটি চিপস, চকলেটের দোকানের পাশাপাশি রয়েছে, মেয়েদের সকল প্রকার কসমেটিকস আইটেম সহ থ্রি পিসের একটি বড় দোকান। বর্তমানে তার এই ব্যবসায় আড়াই লক্ষ টাকার পুজি রয়েছে বলে জানান তিনি।

বেবি আক্তারের এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা যায়, আশেপাশের প্রতিবেশিসহ দূর-দূরান্তের নিয়মিত কাস্টমারদের আসা-যাওয়া রয়েছে তার দোকানে।

তার কাছে থ্রি পিস কিনতে আসা প্রতিবেশী আসমা জানান, বাজার মূল্যে আমরা ঘরের পাশ থেকে মেয়েদের যে কোন প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে পারি, এছাড়াও বেবি আপা টাকার স্বল্পতা থাকলে বাকিতে দিয়ে সহযোগিতাও করেন। বাচ্চাদের টুকিটাকি কেনাকাটার জন্য হাত বাড়ালেই বেবি আপার দোকানে পাওয়া যায় সব। এজন্য নিয়মিত বেবি আপার কাছ থেকেই কেনাকাটা করি। এছাড়াও পশু পালনে বিভিন্ন সহযোগিতায় বেবি আপা আমাদের পাশে থাকেন।

বেবি আক্তার জানান বন্ধের দিনগুলোতে একটু কম বেচাকেনা হলেও, অন্যান্য দিনে তিন থেকে চার হাজার এবং প্রতিমাসে সব মিলিয়ে ৮০ হাজার থেকে  ৯০ হাজার টাকার বিক্রি হয় দোকানে। এতে মাসে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা লাভ থাকে বলে জানান তিনি।


বেবি আক্তার আবেগ ভরা কন্ঠে বলেন বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের দেয়া দশটি মুরগি থেকে আমার শুরু, এখন আমার ৪০ টির বেশি মুরগি আছে, দুইটি দোকান আছে, এছাড়াও আমার ইনকাম দিয়ে আমি সংসার চালাতে পারি। আমার বড় ছেলে আল্লাহর রহমতে ১৩ পাড়া কোরআনের হাফেজ, আর ছোট ছেলে একটি কিন্ডারগার্ডেনে পড়ছে। দুই ছেলের পড়াশুনার খরচ আল্লাহর রহমতে আমিই চালাই। স্বামীর সিএনজি চালানো ইনকামের টাকা খরচ না করলেও হয় আমার।
আপনাদের দোয়ায়, আমার স্বামীর টাকা ও আমার ইনকামের টাকা জমিয়ে ১৪ লক্ষ টাকার জায়গা কিনেছি। দোয়া করবেন, ইচ্ছা আছে খুব তাড়াতাড়ি পাকা বাড়ির কাজে হাত দিবো।
ভাই এর সবকিছুই শুরু, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের দেয়া দশটি মুরগি থেকে। বলতে বলতে আবেগ তাড়িত হয়ে পড়ে বেবি আক্তার। তিনি আরো বলেন প্রতিদিন আমার বাসায় দেশি মুরগির ডিম থাকবেই। যা পরিবারের পুষ্টিগুণ চাহিদা মিটানোর পাশাপাশি বিক্রি করে, এখনো মাসে এক থেকে দুই হাজার টাকা আমার বাড়তি আয় হয়।

বেবি আক্তারের কঠোর পরিশ্রম, ইচ্ছাশক্তি, ও কর্মদক্ষতা থাকায় বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট তাকে বিভিন্ন মেয়াদে পাঁচটি ফ্রী প্রশিক্ষণ করিয়েছে। এ সকল প্রশিক্ষণ করে তিনি এখন মুরগি ছাগল সহ গরুর প্রাথমিক চিকিৎসা নিজেই দিতে পারেন। যে কারণে এলাকার মুরগি ছাগল ও গরু পালনকারী নারীরা বিভিন্ন সময় সহযোগিতা নিতে ছুটে আসে বেবি আক্তারের কাছে। বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগিতায় বেবি আক্তার ৪৪ জন নারী সদস্য নিয়ে শরীফবাগ ইউনিয়নে ‘শরীফবাগ প্রযুক্তি পল্লী মহিলা সমবায় সমিতি’ নামক একটি সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন, এবং তিনি বর্তমানে সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের কার্যক্রম নিয়মিত তদারকি করছেন বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট এর মাঠ সহকারী বোরহানউদ্দিন।

মাঠ সহকারী বোরহানউদ্দিন বলেন বেবি আক্তার একজন পরিশ্রমী ও বুদ্ধিমতী নারী। সে আমাদের দেয়া দশটি মুরগি যত্ন সহকারে লালন পালন করে, কঠোর পরিশ্রম ও নিজের বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে জীবনকে পরিবর্তন করেছে। এক্ষেত্রে আমরা সব সময় আমাদের নিয়মিত কর্মকান্ডের মাধ্যমে তাকে সহযোগিতা করে আসছি। এছাড়াও আমরা বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে বেবি আক্তারকে একটি সমিতি গঠন করে দিয়ে সমিতির সকল নারী সদস্যদের পশু পালনে বিভিন্ন মেয়াদে প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রশিক্ষিত করছি। যেনো প্রতিটি সদস্য ভবিষ্যতে সফল উদ্যোক্তা ও পশু পালনে সফল হতে পারেন ।

বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ফার্নিং সিস্টেম রিসার্চ ডিভিশনের বিভাগীয় প্রধান ডঃ রাজিয়া খাতুন বলেন, ধামরাই উপজেলার শরীফবাগ ইউনিয়নে নিয়মিত পরিদর্শনে গেলে, বেবি আক্তার আমার কাছে কিছু একটা করে দেয়ার জন্য সহযোগিতা চায়। এ সময় আমি তার বাড়িতে গিয়ে দেখতে পাই, তার ছোট্ট ছোট্ট দুটি ছেলে আছে এবং তার স্বামী তেমন কিছু করতেন না একজন শ্রমিক ছিলেন, কোনরকম জরাজীর্ণ অবস্থায় একটি ছোট রুমে থাকতেন তারা।
তখন তাকে আমরা ০৮টি মুরগি ও ০২টি মোরগ, সাথে মুরগির প্রোডাকশনে আসার আগ পর্যন্ত ১৬ থেকে ২০ সপ্তাহের জন্য মুরগির খাবার দেই।

আমাদের তিনটি নেটি চিকেন জাম প্লাজম আছে যেগুলোকে আমরা গবেষণা করে, আমাদের আবহাওয়ার সাথে খাপ খাওইয়ে, দেশি মুরগির সাথে সিলেক্টিভ ব্রিডিং এর মাধ্যমে ইমপ্রুভমেন্ট করিয়েছি। যার ফলে এই জাতগুলো সাধারণ দেশি মুরগির তুলনায় বছরে অনেক ডিম দিয়ে থাকে। যেখানে সাধারণ মুরগি বছরে ৩০ থেকে ৪০ টি ডিম দেয়, সেখানে আমাদের ইমপ্রুভমেন্ট করা এই দেশি মুরগিগুলো ১৮০ থেকে ২৫০টি করে ডিম দিয়ে থাকে। এই উন্নত জাতের মুরগি গুলোই বেবি আক্তারকে দেয়া হয়েছিল। আপনারা জানেন সাধারণত দেশীয় মুরগির ডিম ৫৫ থেকে ৬০টাকা হালিতে বিক্রি হয়। সে ক্ষেত্রে খামারির লাভের পরিমাণ বেশি হয়।

এভাবে যখন বেবি আক্তারকে দেয়া মুরগিগুলোর প্রোডাকশন শুরু হয়। তখন ধীরে ধীরে সে ডিম বিক্রি করে কিছু টাকা পয়সা জমিয়ে, শুনেছি ২৩০০ বা ২৫০০ টাকা দিয়ে মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য, একটি চিপসের দোকান চালু করে। এভাবে দীর্ঘদিন সে ডিম বিক্রি করতো এবং সেই টাকা দিয়ে দোকানের জন্য কিছু কিছু করে মাল কিন্তু।

বেশ কিছুদিন পর আমি তার ওখানে গেলে ওখানকার আরো কিছু মেয়েরা আমাকে বলল আত্মসামাজিক উন্নয়নের জন্য বেবি আক্তারের মত, আমাদেরকেও গরু ছাগল অথবা কাপড় সেলাই প্রশিক্ষণ দেয়া যায় কিনা। যদিও সেলাই প্রশিক্ষণ আমাদের প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট এর কাজ না, তারপরও তাদের খুব আগ্রহ ও অনুরোধের কারণে আমি ২৩ জন মহিলা খামারীকে, বেবি আক্তারের বাসায় চার মাসের একটি সেলাই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দেই।

বেবি আক্তারের সফলতা দেখে গ্রামের অন্যান্য মেয়েরাও অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেরা স্বাবলম্বী হতে আগ্রহী হয়।  তখন তাদেরকে আমি একটি ৪৩ জনের সমিতি গঠন করে দেই। যেখানে প্রত্যেক সদস্যকে, পশু লালন-পালনে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষা দেয়া হয়েছে। এখন তারা প্রত্যেকেই ভ্যাকসিনেশন থেকে শুরু করে প্রাথমিক সব ধরনের চিকিৎসা নিজেরাই করতে পারেন। এবং গ্রামের অন্যান্য মহিলা খামারীদেরকেও এ কাজে সাহায্য করেন।

ডঃ রাজিয়া আরো বলেন মৎস্য ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম মহোদয়, কমিউনিটিতে যারা ক্ষুদ্র খামারি আছেন তাদের সহযোগিতায় এলডিডিপি ও এনএডিপি প্রোগ্রাম থেকে সহযোগিতা করার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
যার আওতায়, সরকারি সহযোগিতায় বেবি আক্তারদের সমিতিকে একটি ছাগলের খাদ্য ( পিলেট-ফিট) তৈরির মেশিন কিনে দেয়া হবে। এতে করে ছাগলের খাদ্য বিক্রি করে সমিতির মেয়েদের একটি রেগুলার ইনকাম এর ব্যবস্থা হবে।
এভাবেই বেবি আক্তারের পরিশ্রম ও আগ্রহে তার নিজের উন্নয়নের পাশাপাশি ওই গ্রামের অন্যান্য মেয়েদেরও উন্নতি হচ্ছে। যে কারণে আমরা মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে তাদেরকে সার্বিক সহযোগিতা করে যাচ্ছি।

     এ বিভাগের আরো সংবাদ
Share via
Copy link
Powered by Social Snap