আজ ২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৮ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

৪০ বছর ধরে আধ্যাত্মিক সাধনায় পিঠে বরশি গেঁথে শূন্যে উড়েন তিনি

বিশেষ প্রতিনিধি -সাভার ( ঢাকা)

পহেলা বৈশাখে সনাতন ধর্মালম্বীদের ঐতিহাসিক চড়ক পূজার পুজারি ও সাধক নিতাই চন্দ্র সরকার, পিঠ জুড়ে বড়শি গেঁথে উড়েন শূন্যে। পেশায় কামার হলেও প্রতিবছর পূজার এক মাস আগে থেকে সন্ন্যাস হয়ে নিরামিষ ভক্ষণ করেন, শেষের ৫ দিন পূজার সময় ঘুরেঘুরে অন্যের বাড়িতে অন্ন গ্রহণ করেন তিনি, থাকেন গোসল ছাড়া এক কাপড়ে।

এভাবেই চলছে তার গত ৪০ বছর ধরে প্রতিবছর পিঠে বড়শি গেঁথে চড়ক গাছে ঝুলে চারদিক প্রদক্ষিণের কঠিন এই সাধনা। দর্শকদের জন্য আনন্দ উপভোগের বিষয় হলেও ঢাকার ধামরাইয়ের কান্দিরকুল গ্রামের বাসিন্দা নিতাইয়ের  জন্য এ কাজ তার প্রভুর সন্তুষ্টি অর্জনের সাধনা এবং প্রশান্তির।

এই সময়টাতে সন্ন্যাসী নিতাইকে খুঁজে পেতে ঘুরতে হয়েছে কয়েকটা গ্রাম। অবশেষে বিকেলের দিকে দেখা মিলে তার। বরশি লাগিয়া শূন্যে উরার এই ভয়ংকর কাজ কি করে করেন ?  ভয় করে না? ব্যথা পান না? এমনসব প্রশ্নে হাসিমুখে তার উত্তর, ‘ইশ্বরের ধ্যানে মগ্ন হলে এসব কিচ্ছু না। আমার কিছুই হয় না।’

প্রতিবছরের মতো পয়লা বৈশাখের দিন সহ আগের ৩ দিনে এবারেও ধামরাইয়ের যাত্রাবাড়ী মাঠে চড়কগাছ পূজা আয়োজন করা হবে। এই পূজার সকল নিয়ম নিতি পালন হবে নিতাই চন্দ্রের হাতেই । প্রথম দুইদিন দেল যাত্রা, দ্বিতীয় দিনে শিব-পার্বতী নাচানো, বাইদানি নাচ ও রাতের বেলা ধুপ নাচ, হাজরা। ধুপ নাচের পর শ্মশান থেকে মৃতদের মাথার খুলি এনে নাচা হয় হাজরা। সেখানে কালী সেজে অপশক্তি বধ করেন সন্ন্যাসীরা। রাতভর নাচের পর আসে পয়লা বৈশাখ।

নিয়ম অনুযায়ী পয়লা বৈশাখের দিনেই চরকে বড়শি ঘোরানো হলেও ধামরাইয়ে একদিন পরে পালন করা হয় অনুষ্ঠানটি। আর এই অনুষ্ঠানেই পিঠে বরশি গেঁথে শূন্যে উড়ে ৭ পাক থেকে ২১ পাক ঘুরবেন নিতাই।

নিতাই চন্দ্র সরকার জানালেন চড়কগাছ পূজার আদ্যোপান্ত। তিনি বলেন, আমার চার পুরুষ এই আচার পালন করে এসেছে। হিসাবে বলা যায় প্রায় ২’শ বছর আমরা এই পূজা করে আসছি। আমার বাবা করতে পারেননি। দাদুর পরে আমি ১২ বছর বয়স থেকে আবার শুরু করি। ৪০ বছর ধরে টানা আমি এই পূজা করে আসছি।

৫০ বছর বয়সী নিতাই চন্দ্র সরকারের কাছে পূজার ইতিহাস জানতে চাইলে হেসে উত্তর দেন তিনি। বলেন, আমি তো পড়াশোনা জানি না। আমার পূর্বপুরুষরা হয়তো জানতেন। বাবাও জানতেন। তবে আমার জানা নেই। শুধু এটা বলতে পারি, এই পূজার সময়ে আমি এক অন্য আধ্যাত্মিক জগতে চলে যাই। ঈশ্বরের জন্যে নিজেকে একদম সপে দেই। একারণে কোন ব্যথা বা কোন অনুভূতিই হয় না। আমি আলাদা এক মানুষ হয়ে যাই।
সে আরো জানায় চড়ক পূজাকে সামনে রেখে সন্ন্যাস গ্রহণের পরে বাড়িতে খাওয়া বন্ধ করে দেই। ঘুরে ফিরে মানুষ যা দেয় তাই খাই। সেটাও শুধু নিরামিষ। সন্ন্যাসীরা (সহযোগীরা) নাচেন। ভক্তরা নিজের সামর্থ্য মতো সিধা (চাল, অর্থ দান) দেয়। এছাড়া সারাবছর আমি কিছু কবিরাজি চিকিৎসা করি। তারাও সিধা দেয়। সেসব একত্র করে ভক্তদের জন্যে পয়লা বৈশাখের পরেরদিন পূজা শেষে ভোগের আয়োজন করি। তাদেরকে সেবা (খাওয়ানো) করাই। তখন আমি নিজেও আমিষ খাই। অনেকে বলে পিঠে ঘি মালিশ করি বা অন্য কিছু করি। কিন্তু আসল কথা হল কিছুই করি না। বড়শি গাঁথার আগে আমি এমনিতেই প্রস্তুত হয়ে যাই। বড়শি গাঁথার আগে উপুড় হয়ে শুই। তখন থেকেই একরকম কোন অনুভূতি থাকে না। তখন বড়শি গাঁথা হয়। ব্যথা পেলে তো চিৎকার করে উঠতাম। কিন্তু কিছুই হয় না। রক্তাক্তও কিন্তু হই না। যে ক্ষত হয় সেটা সারতে একমাস সময় লাগে বড়জোর। কথা বলতে বলতে পিঠ ভর্তি বড়শি গাঁথার দাগ দেখালেন নিতাই চন্দ্র সরকার। বলেন, পিঠে যে ক্ষত হয়েছে সেজন্যে কোন ডাক্তারি ওষুধ বা গাছ গাছন্ত খাই না।
নিতাই চন্দ্র সরকারের পরে এমন করে সন্ন্যাস গ্রহণ করতে কেউ প্রস্তুত হচ্ছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি তো দাদুর কাছ থেকে শিখেছি। তারপর পালন করছি। পূর্বপুরুষদের রীতিকে আঁকড়ে ধরেছি। একইভাবে আমার ছেলে ও ভাতিজাও শিখছে। তারাও পালন করবে।
পূজা করতে গিয়ে কখনো বাঁধার মুখে পড়েছেন কিনা? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, যখন থেকে পূজার সময় শুরু হয়। হিন্দু মুসলিম সবাই সহযোগিতা করে। উৎসাহ দেয়। চড়ক গাছে ঘোরানোর দৃশ্য দেখতে আসে হাজার হাজার মানুষ। তখন বিষয়টা যতটা না পূজার আচার থাকে, তারচেয়ে বেশি হয় উৎসব। সেখানে হিন্দু মুসলিম সবাই আসে।

চড়ক পূজার ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, হিন্দু শাস্ত্রের কৃষ্ণের রাজধানী দ্বারকা যেটি বর্তমান ভারতের গুজরাতের দ্বারকা নামে পরিচিত। সেখানকার তৎকালীন প্রধান দ্বারকাধীশের সঙ্গে যুদ্ধে শিব উপাসক বনরাজা ক্ষত বিক্ষত হন। পরে সেভাবেই মহাদেব শিবের প্রতি উপাসনা করে অমরত্ব লাভের জন্য নাচগান করেন। নিজের শরীরের রক্ত শিবের প্রতি সমর্পণ করেন। সেই ঘটনার স্মরণে এইদিনে শিব প্রীতির জন্য এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।

     এ বিভাগের আরো সংবাদ
Share via
Copy link
Powered by Social Snap