কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার হাসিমপুর গ্রামের আরিফ বিশ্বাস। তার মেয়ে লিপি খাতুনের কোলে দেড় বছরের শিশু সন্তান রাহাত। পাবনা মানসিক হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসক দেখাতে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছেন।
আলাপকালে আরিফ বিশ্বাস জানালেন, সকাল ৯ টায় সিরিয়াল দিয়েছেন। দুপুর ১২টা বাজতে চললেও এখনও ডাক্তারের মুখ দেখতে পারেননি। যে ভিড়, কখন ডাক্তার দেখাতে পারবেন তাও জানেন না। পরে অবশ্য একটার দিকে চিকৎসককে দেখিয়ে বাড়ি ফেরেন তিনি। শুধু আরিফ বিশ্বাসই নন। তার মতো দেশের দূর-দূরান্ত থেকে মানসিক রোগী নিয়ে পাবনা মানসিক হাসপাতালে আসা স্বজনদেরও একই অবস্থা। একটিমাত্র আউটডোরে চিকিৎসকের কাছে রোগী দেখাতে এসে পোহাতে হয় সীমাহীন দুর্ভোগ।ঝিনাইদহের হরিনাকুন্ডু থেকে মেয়েকে নিয়ে এসেছেন রবিউল ইসলাম। বলেন, বছর খানেক আগে একবার নিয়ে এসেছিলেন। চিকিৎসায় সুস্থ হয়েছিল। আবার মেয়েটা পাগলামি শুরু করেছে। তাই নিয়ে এসেছেন তিনি। কিন্তু এখানে একটু বসা বা বিশ্রামের কোনো ব্যবস্থা নেই।কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার আলম আলী বিশ্বাস স্ত্রী কনা খাতুনকে নিয়ে গত ৫ বছর ধরে চিকিৎসা করাচ্ছেন পাবনা মানসিক হাসপাতালে। প্রতিবারই তাকে দুর্ভোগে পড়তে হয়। সিরিয়াল দিয়ে বসে থাকতে হয়। প্রচণ্ড ভিড়ে সুস্থ মানুষও অসুস্থ হওয়ার যোগাড়। চিকিৎসক কম। রোগীকে ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।এর অন্যতম কারণ জনবল সঙ্কটে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে মানসিক রোগের চিকিৎসাসেবায় দেশের একমাত্র বিশেষায়িত পাবনা মানসিক হাসপাতালের কার্যক্রম। চিকিৎসক সঙ্কটে ব্যহত হচ্ছে হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা। মাত্র ৩ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে ৫শ শয্যার আন্ত:বিভাগ-বহির্বিভাগ সামলাতে হিমশিম খেতে হয় প্রতিদিন। ৬৪৩টি মঞ্জুরীকৃত পদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে শূন্য ২০১টি পদ। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিষয়টি বারবার সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি চালাচালি করলেও কাজ হচ্ছে না।এমন বাস্তবতার মাঝেই আজ (রোববার) পালিত হচ্ছে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘অসম বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্য’। ১৯৫৭ সালে পাবনা শহরের শীতলাই হাউজে অস্থায়ীভাবে স্থাপন করা হয় পাবনা মানসিক হাসপাতাল। এর দুই বছর পর ১৯৫৯ সালে সদরের হেমায়েতপুরে ১১১ দশমিক ২৫ একর জায়গার উপরে স্থানান্তর করা হয় হাসপাতালটি।পাবনা মানসিক হাসপাতালের আবাসিক সাইকিয়াট্রিস্ট মাসুদ রানা বলেন, তারা মাত্র তিনজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ৫শ শয্যার হাসপাতালের আন্ত:বিভাগ ও বহির্বিভাগ সামলাচ্ছেন। এটা খুবই কষ্টকর একটা ব্যাপার। তাদের অনেক সময় নাভিশ্বাস উঠে যায়।হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার শাহিন রেজা বলেন, হাসপাতালের অনেকগুলো ওয়ার্ড রয়েছে। কোনো ওয়ার্ডে ৪০ জন রোগী আছে। একজন চিকিৎসকের পক্ষে ৪০ জনের সেবা দেওয়া কঠিন। সেখানে প্রতিটি ওয়ার্ডে যদি দু’জন করে চিকিৎসক থাকতো তাহলে প্রতিটি রোগী আরও ভাল চিকিৎসা সেবা পেতেন।নার্সিং সুপারভাইজার রাশেদা খাতুন ও আব্দুল কাদের বলেন, তারা মানসিক রোগীদের আপনজন হয়ে সেবা দেন। কেউ খেতে না চাইলে তাকে বুঝিয়ে খাওয়াতে হয়। গোসল করিয়ে দিতে হয়। নখ কেটে দিতে হয়। ওষুধ খাইয়ে দিতে হয়। তা না হলে তাদের সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। তবে লোকবলের অভাবে তাদের দায়িত্ব পালনে কষ্ট বেড়ে যায়।তারা জানান, অনেক ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করেন তারা। রোগীদের হাতে মার পর্যন্ত খেতে হয়। ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করলেও তাদের জন্য নেই ঝুঁকিভাতা। সরকারের কাছে ঝুঁকিভাতা চালুর দাবি জানান তারা।এ বিষয়ে হাসপাতালের পরিচালক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান, চিকিৎসক পদায়নসহ জনবল সঙ্কটের বিষয়টি নিয়ে বারবার মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হলেও পরিস্থিতির উন্নতি নেই। উন্নত চিকিৎসাসেবা দিতে জনবল বাড়াতে হবে।