বিশেষ প্রতিনিধি সাভার (ঢাকা)
আশুলিয়ায় পুলিশের এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বানোয়াট মামলায় সাবেক সেনাসদস্যকে আটকের অভিযোগ উঠেছে। ফ্ল্যাটের মালিকানা দ্বন্দ্বে পুলিশের সখ্যতা কাজে লাগিয়ে চুরির একটি বানোয়াট মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগ করেন, ভুক্তভোগী সাবেক সেনাসদস্য রাজু সহ প্রতিবেশী ফ্ল্যাটের অন্যান্য মালিকগণ।
আশুলিয়ার দক্ষিণ গাজীরচট এলাকায়, যৌথ মালিকানায় ১২শতাংশ জমির উপর ৮ ইউনিট বিশিষ্ট ৪র্থ তলা ভবন নির্মাণ করে ৮ জন মালিক।
ভুক্তভোগী রাজু ও অভিযোগকারী দুলাল আটজনের দুইজন মালিক। তারা দুইজন অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য।
অভিযোগকারী দুলালের স্ত্রী ও আশুলিয়া থানার পরিদর্শক তদন্ত জিয়াউল ইসলামের দেশের বাড়ি একি এলাকায়। সেই সুবাদে তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক রয়েছে, যার প্রভাব খাটিয়ে এই মামলা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
দুলাল হোসেন ও তার স্ত্রী আছমা সুলতানার পক্ষ থেকে মামলা করার আগেই, গত মঙ্গলবার রাতে আশুলিয়ার দক্ষিণ গাজীরচট এলাকার নিজ বাসা থেকে আটক করা হয় অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য রাজু আহম্মেদকে। পরদিন আশুলিয়া থানায় একটি চুরির মামলা হয়। এরপর তাকে আদালতে পাঠানো হয়।
এর আগেও আশুলিয়া থানার পরিদর্শক তদন্ত জিয়াউল ইসলামের বিরুদ্ধে, আশুলিয়ার কবিরপুর এলাকায় অন্যকে ঝুট ব্যবসা দখল পাইয়ে দিতে, মূল মালিককে দুটি মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগ ওঠে। যা বিভিন্ন গনমাধ্যমে বিশেষ প্রতিবেদন আকারে প্রকাশিত হয়।
গ্রেপ্তার রাজুর স্ত্রী আসমা আহম্মেদ বলেন, ‘গাজীরচট এলাকার চতুর্থ তলায় আমার একটা ফ্ল্যাট আছে। তখন আমাদের এক শেয়ারমেট (দুলাল হোসেন ও তার স্ত্রী আছমা সুলতানা) বলছে তিনি কিনবেন। সম্পর্ক ভালো থাকায় ১০ হাজার টাকায় তার সঙ্গে ফ্ল্যাটটি মৌখিক বায়না করি। কথা ছিল বাকি ৭ লাখ টাকা পরে দেবে।
‘কিন্তু ফ্ল্যাটের ৭ লাখ টাকা না দিয়েই দুলাল-আছমা দম্পতি ফ্ল্যাটের ভেতরে গোপনে নির্মাণকাজ করে যাচ্ছিল। বিষয়টি জানতে পেরে আমি প্রতিবাদ করতে গেলেই আমাদের মারধর করতে আসেন ওনারা। অনেকবার থানায় গেলেও পুলিশ মামলা নেয়নি। স্থানীয়ভাবে মীমাংসার জন্য ওনাদের ডাকা হলেও তারা বসেননি। পরে আমরা ফ্ল্যাটটি অন্যজনের কাছে বিক্রি করি।’
তিনি জানান, গত বুধবার দুলাল ও আছমারা জোরপূর্বক ফ্ল্যাট দখল করতে আসলে তাদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে দুলালের স্ত্রী থানায় ফোন করে পুলিশ ডেকে আনেন। তখন রাজুকে ধরে নিয়ে যান এসআই মিলন ফকির। পরদিন চুরি, জখম, ভাঙচুরের মামলা করেন দুলালের স্ত্রী আছমা।
রাজুর স্ত্রী বলেন, ‘মূলত থানার ওসি জিয়া ও আছমার বাড়ি ময়মনসিংহ জেলায়। সখ্যতার কারণে ওসি সাহেব ওই মহিলার পক্ষ নিয়ে মিথ্যা মামলায় আমার স্বামীকে গ্রেপ্তার করেছেন।’
ওই ভবনের ফ্ল্যাট মালিকদের প্রধান মালিক সাবেক সেনাসদস্য, সিনিয়ার ওয়ারেন্ট অফিসার, গোলজার হোসেন বলেন, ‘আমরা আটজন সেনাসদস্য নিজেদের জমানো অর্থ দিয়ে চারতলা এই বাড়িটি নির্মাণ করেছি। পুরো বাড়ি আমার তত্ত্বাবধানেই হয়েছে।
‘নির্মাণ শেষ হওয়ার পর অংশীদারদের ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু চারতলার দুলাল-আছমা দম্পতি জোর করে নিচের একটি দোকান ও নিচতলার আরেকটি ফ্ল্যাট দখল করে ভাড়া আদায় করছেন। প্রতিবাদ করতে গেলে নানা হুমকি দিয়ে আসছেন। এমনকি এলাকাভিত্তিক মীমাংসার জন্য বসা হলে সেখানে দুলাল ও তার ছেলে লোকজন ভাড়া করে এনে আমাদের মারধর করে। থানায় গিয়েও এর কোনো প্রতিকার পাইনি।’
গোলজার বলেন, ‘তখন ওসি (আসলে পরিদর্শক-তদন্ত) জিয়া মামলা না নিয়ে আমাদের বলেন, সব মিটমাট করে ফেলেন। পরে আমরা জানতে পারলাম জিয়ার গ্রামে নাকি আছমা-দুলাল দম্পতির বাড়ি। পক্ষ নিয়ে তখনও আমাদের সঙ্গে উনি খারাপ আচরণ করেছেন।’
এই সাবেক সেনাসদস্য বলেন, ‘ওসি জিয়ার ক্ষমতাবলে তারা (দুলাল ও আছমা) ফ্ল্যাটের অন্য কোনো মালিককে পরোয়া করেন না। একই কারণে রাজু আহমেদকেও মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়েছে তারা। এখানে মামলা দেয়ার কোনো কারণ দেখি না আমরা। কারণ এখানে কোনো মারামারি, চুরির ঘটনা ঘটে নাই।’
আরেক ফ্ল্যাট মালিক সাবেক সেনাসদস্য সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘পুলিশকে দিয়ে রাজুকে হয়রানি করছে দুলাল ও আছমা দম্পতি। জবরদখল করে রাখছে ফ্ল্যাটও।’
আশুলিয়া থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের অর্থবিষয়ক সম্পাদক জামাল উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, ‘বিষয়টি স্থানীয়ভাবে মীমাংসার জন্য ডাকা হলেও দুলাল-আছমা দম্পতি আসেননি। এখন তারা পুলিশের প্রভাব খাটিয়ে অবৈধভাবে ফ্ল্যাট দখল করেছেন। পুলিশ একতরফাভাবে দুলাল-আছমা দম্পতির পক্ষে কাজ করেছে। পুলিশ নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবে এটাই সবার কাম্য।’
মামলা করার বিষয়ে বাদী আছমা সুলতানা বলেন, ‘ওনারা আমার ফ্ল্যাটে ঢুকে আমার স্বামী, ছেলে-মেয়েসহ আমাকে রড, লাঠি দিয়ে মারধর করেছে। স্বর্ণ, টাকা নিয়ে গেছে। তাই মামলা করেছি।’
তিনি বলেন, ‘করোনাকালীন ৭ লাখ ১০ হাজার টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কিনেছি। বিশ্বাসের জায়গা থেকে কোনো স্ট্যাম্প কিংবা ডিডে লিখিত কোনো ডকুমেন্ট রাখিনি। এটাই আমাদের ভুল হইছে।’
পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ জিয়াউল ইসলামের সঙ্গে কোনো সখ্য আছে কি না এমন প্রশ্নে আছমা বেগমের স্বামী দুলাল হোসেন বলেন, ‘আমার বাড়ি ময়মনসিংহের ভালুকা। আর তার বাসা ময়মনসিংহে।’
আশুলিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ জিয়াউল ইসলাম বলেন, 'এটা ফ্ল্যাটের মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব। চেয়ারম্যান বলেছিল মীমাংসা করে দেবে। কিন্তু ওরা (রাজু আহম্মেদ) শোনেনি। দিনেদুপুরে লোকজন নিয়ে মহিলার (বাদীর) ফ্ল্যাটে তালা লাগিয়ে দিয়েছে।'
মামলায় যে অভিযোগ আনা হয়েছে, সেটি তো সত্য নয় বলে প্রতিবেশী ফ্ল্যাটের মালিকরা বলছেন, এমন প্রশ্নে পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘অভিযোগ দিলেই তো হলো না। ওইটা তো আমরা তদন্ত করে যেটা প্রমাণ হবে ওইটাই হবে। মামলার তো আর চার্জশিট হয় নাই। অভিযোগ তো অনেকে অনেক কিছু দেয়। কিন্তু তদন্তসাপেক্ষে আমরা তো অনেক কিছু পাই, অনেক কিছু দিই।
‘প্রাথমিক তদন্তে তো দুই গ্রুপের মারামারির খবর পেয়েছি। ঘরে গিয়া তালা মাইরা দিছে। তখন গিয়া ওনাকে (রাজু আহম্মেদ) আনা হইছে।’
বাদীর সঙ্গে সখ্যের বিষয়ে তথ্য নিয়ে তিনি বলেন, ‘না না। বাড়তি সুবিধা পেলে তো অনেক আগেই পেত। এতদিন কেন সে বাড়তি সুবিধা পায় নাই?'
ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘যদি এ ধরনের কোনো ঘটনা হয়ে থাকে। তাহলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’